
জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হয়নি, স্বীকার করলেন তাজুল
সহিংস হামলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাতে মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রসিকিউশনের কাছে ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে প্রতিবেদন দাখিল করেছে তদন্ত সংস্থা। তবে এসব ঘটনায় যে অপরাধ হয়েছে, তা গণহত্যার সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না বলে অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন চিফ প্রসিকিউটর ও একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম।
গত ৫ই আগস্টের পর থেকে ইউনূস সরকার ও তার সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকেই প্রতিটি বক্তব্যে জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলীকে গণহত্যা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও সেসময়কার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গণহত্যাকরী হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেই বক্তব্য থেকে সরে এলো ইউনূস সরকার। ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর সংবাদ সম্মেলনে গতকাল এ বিষয়ে জানালেন তাজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, গণহত্যার কোনো চার্জ বা অভিযোগ নেই। আন্তর্জাতিকভাবে যে সংজ্ঞা রয়েছে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশে যেসব অপরাধ হয়েছে, তা ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি বা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’! এটি গণহত্যার অপরাধ নয়। বাংলাদেশে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, সেটি জেনোসাইড নয়।
জুলাই-আগস্টের সরকারবিরোধী আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৫টি অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। তিনি ‘মাস্টারমাইন্ড, হুকুমদাতা ও সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে এসব অপরাধ সংঘটন করেছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই প্রথম কোনো মামলায় তদন্ত শেষ হলো বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম।
এই মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আনা হয়েছে।
রাজাকারদের আইনজীবী ও বর্তমান চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে আসা তথ্য ও অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করার পর আনুষ্ঠানিকভাবে তা দাখিল করা হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। তারপর শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম। ২-৩ সপ্তাহের মধ্যে উল্লেখিত ৩ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হবে।
জুলাই-অগাস্টে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগে গণহত্যার কোনো অভিযোগ আনা হয়নি বলে নিশ্চিত করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল জানান, দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করা হবে কি না, তা ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জামায়াতে ইসলামীর এই আইনজীবী বলেন, গত রাতেই মাত্র এ আইনে সংশোধনী এসেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে তদন্ত সংস্থা মনে করলে দলটি ‘মানবতাবিরোধী’ অপরাধ করেছে কি না, সে বিষয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
২০১০ সালের ২৫শে মার্চ শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। সে ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধী নেতাদের বিচার করা হয়েছিল। যেখানে কুখ্যাত রাজাকারদের আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাজুল ইসলাম।
অন্তর্বর্তী সরকার সেই তাজুল ইসলামকে সেই ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর করা হয়। যাকে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বলছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। যদিও এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি ইউনূস সরকার। তাজুল ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনে সংশোধনী এনে সেই ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ তাঁর মন্ত্রিপরিষদ, তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিচার করা হচ্ছে।
ড. ইউনূসের উল্লেখ করা ‘মেটিক্যুলাস ডিজাইন’ প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমে জুলাই-আগস্টে যেসকল সহিংসতা, সংঘাত ও গুপ্তহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার ‘উস্কানিদাতা’ আখ্যা দিয়ে উল্টো শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এক নম্বর অভিযোগ আনা হয়েছে। রাজাকারদের আইনজীবী তাজুল দাবি করেন, তিনি (শেখ হাসিনা) এসব অপরাধের উস্কানি ও প্ররোচনা দিয়েছিলেন।
এসময় তাজুল গত ১৪ই জুলাই শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা টেনে দাবি করেন, তিনি (শেখ হাসিনা) আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা, রাজাকারের নাতি-পুতি, রাজাকার—বলেছেন। এভাবে রাজাকার বলায় রাষ্ট্রীয় সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘লেলিয়ে দেওয়া’ হয়েছিল বলে দাবি করেন তাজুল।