Tuesday 06 May, 2025

বৈছাআ’দের গণমামলা-গণআসামির ফাঁদে দেশের সাধারণ মানুষ

নিজস্ব প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 23:05, 30 April 2025

বৈছাআ’দের গণমামলা-গণআসামির ফাঁদে দেশের সাধারণ মানুষ

বৈছাআ’দের গণমামলা-গণআসামির ফাঁদে দেশের সাধারণ মানুষ

গত বছরের জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে হওয়া আন্দোলনের সময়কার সহিংসতা, হত্যা ও হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১,৪৯৯টি মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। তবে এসব মামলায় ব্যাপকসংখ্যক ব্যক্তিকে একযোগে আসামি করাকে ঘিরে উঠে এসেছে চাঁদাবাজি, ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের মতো উদ্দেশ্যের অভিযোগ।

এই পরিস্থিতিতে মামলা দায়েরের সঙ্গে সঙ্গে আসামিদের গ্রেপ্তার না করতে পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে সদরদপ্তর।

সম্প্রতি মিরপুর থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় অভিনেতা ইরেশ যাকেরসহ ৪০৭ জনকে একসঙ্গে আসামি করায় ব্যাপক সমালোচনা হয়। এরই মধ্যে ২৯শেএপ্রিল, মঙ্গলবার রাজধানীর ভাটারা থানায় দায়ের হয় আরও একটি আলোচিত মামলা—যেখানে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস, নুসরাত ফারিয়া, জায়েদ খানসহ ১৭ জন শিল্পীকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট আসামির সংখ্যা ২৮৩ জন।

ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম জানান, “আদালতের নির্দেশে মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব। পুলিশ সদরদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, মামলা হলেই গ্রেপ্তার নয়। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে কাউকে গ্রেপ্তার করা হবে না।”

এজাহারে বলা হয়েছে, গত বছরের জুলাই মাসে ভাটারা এলাকায় মামলার মূল অভিযোগ—হত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটে। অভিযোগে যেসব জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পীর নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, সুবর্ণা মোস্তফা, রোকেয়া প্রাচী, আসনা হাবিব ভাবনা, সোহানা সাবা, মেহের আফরোজ শাওন, জ্যোতিকা জ্যোতি, সাইমন সাদিক, জায়েদ খান ও আজিজুল হাকিম।

মিরপুর থানায় দায়ের হওয়া একটি আলোচিত হত্যা মামলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪০৭ জনকে একসঙ্গে আসামি করা হয়েছে। মামলাটির অন্যতম আলোচিত নাম অভিনেতা ইরেশ যাকের, যাকে আসামি করায় দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। একই মামলায় কয়েকজন সাংবাদিককেও আসামি করা হয়েছে।

মামলাটি দায়ের করেন নিহত ছাত্রদল কর্মী মাহফুজ আলম শ্রাবণের ভাই, বিএনপির কর্মী মোস্তাফিজ বাপ্পি। অভিযোগে বলা হয়, গত ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর বিকেলে মিরপুরে ‘গুলি ও গ্রেনেড হামলা’ চালিয়ে শ্রাবণকে হত্যা করা হয়। এরপর ২০শে এপ্রিল আদালতে মামলা দায়ের করা হলে ২৭শে এপ্রিল আদালতের নির্দেশে মিরপুর থানা সেটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে।

মামলার বাদী মোস্তাফিজ বাপ্পি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। ঢাকাতেই ছিলাম না। অন্যদের কাছ থেকে শুনে মামলা করেছি। গণমামলার একটা পদ্ধতি আছে, সেটি অনুসরণ করেই করেছি।”

তিনি আরও জানান, “আসামিদের অনেককেই আমি চিনি না। তদন্তেই বেরিয়ে আসবে কে জড়িত, কে নয়।”

ইরেশ যাকেরকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে বাপ্পি বলেন, “তিনি তো আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে ব্যবসা করেন। তাদের এশিয়াটিক নামের একটি অ্যাড ফার্ম আছে। নূর ছিলেন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, ফলে ইরেশ যাকেরও তো সুবিধাভোগী।”

মামলার আটজন সাক্ষীর মধ্যে কয়েকজনের বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মিরপুরের জয়নাল আবেদীন নামে এক ব্যক্তি বলেন, “আমি মামলার সাক্ষী হয়েছি—এ কথা মামলার পর পুলিশ ফোন করে জানায়। ঘটনাস্থলে আমি ছিলাম না। আমার দোকানের পাশেই শ্রাবণ ভাড়া থাকত, চা খেতে আসত—এটুকুই জানি।”

আরেক সাক্ষী সাইফুল ইসলাম বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম। গুলিতে পাঁচজন মারা যায়, কিন্তু পুলিশের বাইরে অন্য কাউকে জড়িত দেখিনি।”

মিরপুর থানা পুলিশ বলছে, আদালতের নির্দেশে মামলা নেওয়া হয়েছে। তদন্তে কারও সংশ্লিষ্টতা না থাকলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে না। পুলিশের ভাষ্য, তদন্ত আইনি প্রক্রিয়াতেই চলছে।

পুলিশ সদরদপ্তর জানায়, গত বছরের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় সহিংস ঘটনায় মোট ১,৪৯৯টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৯৯টি হত্যা মামলা। এসব মামলায় ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশ কিছু মামলার তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে বলেও জানানো হয়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক ডয়চে ভেলেকে জানান, বর্তমানে দায়ের হওয়া বহু গণমামলার পেছনে মূল উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি।

তিনি বলেন, “মামলার একটি নির্দিষ্ট কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যেখানে নিয়মিতভাবে শেখ হাসিনা, সরকারের মন্ত্রী-এমপি, কিছু সাংবাদিক ও পরিচিত ব্যক্তিদের নাম রাখা হয়। এরপর টাকার বিনিময়ে অন্যান্য ব্যক্তিদের নাম যুক্ত বা বাদ দেওয়া হয়।”

তার ভাষায়, “প্রথমে মামলার খসড়া করে টার্গেট ব্যক্তিদের নাম দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়। পরে তদন্তে বাদীর মাধ্যমে ভুল হয়েছে বলে টাকা দেওয়া ব্যক্তিদের নাম বাদ দেওয়া হয়। বিচারপর্যায়ে গিয়ে সাক্ষ্য না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরও টাকা নেওয়া হয়।”

ব্যারিস্টার ফারুক আরও বলেন, “এখন মামলা বানানোর জন্য একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় হয়েছে। তারা ঘটনাও বানায়, বাদীকেও ঠিক করে দেয়। টাকা-পয়সার প্রলোভন দেখিয়ে নিরীহ মানুষকে এই প্রক্রিয়ার অংশ করে। সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ না করলে প্রকৃত মামলাগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যাবে এবং সাধারণ মানুষ আরও বড় বিপদের মুখে পড়বে।”

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) নূর মোহাম্মদ বলেন, “ভুয়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা আগেও ছিল, কিন্তু এবার তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সরকারের উপদেষ্টারাও বিষয়টি বলছেন, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।”

তিনি মনে করেন, “থানা যদি প্রাথমিক অনুসন্ধান করেই মামলা গ্রহণ করত, তাহলে এমন গণআসামি হওয়া বন্ধ হতো। এখন একটি চক্র এটি ব্যবসার রূপ দিয়েছে এবং নানা শ্রেণির মানুষ এতে যুক্ত হয়ে গেছে।”

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, আন্দোলনকেন্দ্রিক দায়ের হওয়া অনেক মামলায় অসঙ্গতি, সমন্বয়হীনতা এবং হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।

তারা বলেন, “নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি করায় এসব মামলার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।”

আসকের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “নাগরিকদের মামলা করার অধিকার থাকলেও যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাউকে ফাঁসানো বা হয়রানির উদ্দেশ্যে নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল।”

সংস্থাটি এও দাবি করে, “অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কার ‘গায়েবি মামলা’ সংস্কৃতি যেন আবার ফিরে এসেছে। এমন অনেক মামলায় দেখা গেছে—ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত ব্যক্তিদেরকেও আসামি করা হয়েছে, এমনকি কিছু মামলায় আসামির নাম-ঠিকানা হুবহু এক।”

পুলিশ সদরদপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর জানান, “নিহত-আহতদের বিষয়ে দায়ের করা মামলাগুলো আমরা পর্যবেক্ষণে রেখেছি। সিনিয়র কর্মকর্তারা এসব মামলার অগ্রগতি নিবিড়ভাবে দেখছেন।”

তিনি বলেন, “নাগরিকদের মামলা করার অধিকার আছে, তবে কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন, সেটাও নিশ্চিত করাই আমাদের দায়িত্ব।”

পুলিশ সদরদপ্তর থেকে ইতোমধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—মামলা হলেই সঙ্গে সঙ্গে কাউকে গ্রেপ্তার না করে তদন্তের ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

সূত্র: ডয়চে ভেলে