
মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপে দেশের একমাত্র নারী ভিসি অপসারিত
মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপ ও ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার মুখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন, উপ-উপাচার্য (প্রোভিসি) অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী এবং কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. মামুন অর রশিদকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। দেশের একমাত্র নারী উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ড. শুচিতা শরমিনের এই অপসারণ মৌলবাদীদের তাণ্ডব ও প্রগতিবিরোধী মনোভাবের আরেকটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মঙ্গলবার (১৩ মে) রাত সাড়ে ৯টার দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব এ এস এম কাসেমের স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে ড. শুচিতা শরমিনকে উপাচার্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রোভিসি ও কোষাধ্যক্ষকেও তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। নতুন উপাচার্য নিয়োগের আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও ক্যামিকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তৌফিক আলম দায়িত্ব পালন করবেন।
জুলাই আন্দোলনের পরে ভিসি, প্রভিসি, প্রোক্টর, শিক্ষকদের অপসারন একটি নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদাহারন ছড়িয়ে পড়েছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও, বাদ যায়নি স্কুল কলেজও। ছাত্ররা ক্ষমতায়িত হয়েছিল জুলাই আন্দোলনে, এবং সরকার সেটাকে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে অদ্যবধি। কিছুদিন আগে ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির সিইসি ডিপার্টমেন্টের ডিনকে অপসারন করা হয়, এর পরে কুয়েটের ভিসির বিরুদ্ধে টানা আন্দোলন করে অপসারন করা হয়। অবস্থাদৃষ্ট এমন দাঁড়িয়েছে, চেহেরা পছন্দ না হলেও শিক্ষক অপসারন এখন স্বাভাবিক বিষয়। এ যেন, কে কতো শিক্ষক অপসারন করতে পারে, সেই প্রতিযোগীতায় লিপ্ত সরকার আশ্রিত ছাত্ররা।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ কর্মকর্তা ফসসাল মাহমুদ জানান, ড. শুচিতা শরমিনকে অপসারণ করে ড. মো. তৌফিক আলমকে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই অপসারণের পর শিক্ষার্থীরা রাত ১০টার দিকে প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে আনন্দ মিছিল করেছে।
গত ২৯ দিন ধরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথমে ২২ দফা, পরে চার দফা এবং সবশেষে উপাচার্য অপসারণের এক দফা দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যক্রম শাটডাউন, উপাচার্যের বাসভবনে তালা এবং একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। ১২ মে রাত ১১টা থেকে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন শুরু করে এবং ১৩ মে বিকেল থেকে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এই তীব্র আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় ড. শুচিতা শরমিনকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়।
ড. শুচিতা শরমিন ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য এবং বর্তমানে দেশের একমাত্র নারী উপাচার্য। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি এই পদে নিয়োগ পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের এই অধ্যাপক মনোবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে বিএসসি ও এমএসসি সম্পন্ন করেন এবং ২০০৩ সালে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তার ৪৫টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং তিনটি বই রয়েছে। তার এই শিক্ষাগত ও গবেষণামূলক অবদান সত্ত্বেও, মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রভাবে উসকানিমূলক ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে অপসারণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই অপসারণ শুধু একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং মৌলবাদী ও প্রগতিবিরোধী শক্তির কাছে প্রশাসনের নতি স্বীকারের প্রমাণ। ড. শুচিতা শরমিনের নারী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগের পর থেকেই তিনি মৌলবাদী গোষ্ঠীর নিশানায় ছিলেন। আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের উসকে দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পঙ্গু করে দেওয়ার মাধ্যমে এই গোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেছে। এই ঘটনা দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী নেতৃত্বের প্রতি মৌলবাদীদের বৈরিতার আরেকটি উদাহরণ।
উপাচার্য অপসারণের পর শিক্ষার্থীরা আনন্দ মিছিল করলেও, সমাজের বিভিন্ন মহলে এই ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এই অপসারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও একাডেমিক পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একজন শিক্ষাবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মৌলবাদীদের চাপে একজন যোগ্য নারী উপাচার্যকে অপসারণ করা শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত। এটি নারী নেতৃত্বের প্রতি আক্রমণ এবং প্রগতিশীল শিক্ষার পথে বাধা।